১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষে ভারতীয় বাহিনীর লুটপাট, ইতিহাসের এক ঘৃণিত অধ্যায় |
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো হয় ১২ মার্চ ১৯৭২, ঢাকা স্টেডিয়ামে এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই বিদায় দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে বিদায়ী শুভেচ্ছা বার্তায় বলেন:
“আমাদের মহাসংকটের সময়ে আপনাদের প্রসারিত সাহায্যকে আমরা সর্বদা গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো… আপনাদের প্রতি আমাদের জনগণের অকৃত্রিম ভালবাসা রইলো।”
কিন্তু ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে এই বিদায়ের এক বিতর্কিত দিক, বাংলাদেশ ছাড়ার সময় ভারতীয় বাহিনী দেশজুড়ে চালায় ব্যাপক লুটপাট। এ লুটের ঘটনা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী বাঙালিদেরই নয়, বিদেশি সংবাদমাধ্যমেরও দৃষ্টি কেড়েছিল।
প্রসঙ্গ: সর্বব্যাপী লুটপাট:
বিভিন্ন সূত্র ও বিদেশি সংবাদমাধ্যম, যেমন দ্য গার্ডিয়ান, তখন জানিয়েছিল, ভারতীয় সেনারা কেবল পাকিস্তানি বাহিনীর পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্রই নয়, মিল-কারখানার যন্ত্রপাতি, খাদ্যশস্য, পাট, সুতা, প্রাইভেট কার, এমনকি সমুদ্রগামী জাহাজ পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যায়। এ লুটের পরিমাণ সেই সময়কার হিসাবে ছিল প্রায় ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ঢাকা, যশোর, খুলনা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্ট, শিল্পাঞ্চল ও শহরগুলোতে ভারতীয় সেনাদের লুটপাটের প্রমাণ পাওয়া যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “পূর্ব-পশ্চিম”-এ লেখেন:
“ঢাকায় এতসব বিদেশী জিনিস পাওয়া যায়, এসব তো আগে দেখেনি ভারতীয়রা। রেফ্রিজারেটর, টিভি, টু-ইন-ওয়ান, টিনের খাবার, এইসব ভর্তি হতে লাগলো ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাকে।”
সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে লুটপাটের বিচার:
ভারতীয় বাহিনীর একাধিক শিখ অফিসার ও তাদের অধীনস্থ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। ব্রিগেডিয়ার মিশ্র নামে এক কর্মকর্তা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফ্রিজ, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজসহ ট্রাকভর্তি জিনিসপত্র ভারতে পাচার করার দায়ে কোর্ট মার্শাল হন।
মেজর জলিলের প্রতিরোধ ও গ্রেফতার:
খুলনা অঞ্চলে নবম সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন এবং কিছু সম্পদ রক্ষার উদ্যোগ নেন। এরই জেরে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭২ তাকে যশোরে ভারতীয় বাহিনী গ্রেফতার করে এবং এক নির্জন বাড়িতে বন্দী করে রাখে, যা পূর্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টর্চার সেল ছিল।
এই বাড়িতে ঠাঁই হয় দেশের প্রথম রাজবন্দীর, স্বাধীন বাংলাদেশের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা, মেজর জলিলের। পাশেই চলছিল ভারতীয় সেনাদের বর্ষবরণ উৎসব, আর ঘরের ভিতরে শীত, আধা ছেঁড়া কম্বল আর নির্জনতা।
জলিল ছাড়াও আগরতলা মামলার অভিযুক্ত: সুলতানউদ্দিন আহমেদ ও মোঃ খুরশিদ-কে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে জলিলের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল হলেও তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। বিচারক ছিলেন আরেক সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের। যদিও দায়মুক্তি পান, মেজর জলিল নিজের সম্মানের কারণে স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।
ইতিহাসের দায়:
ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে বিদায়ের সময়ে এই বাহিনীর একাংশের লুটপাট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অস্বস্তিকর অধ্যায় হয়ে রয়েছে। এটি কেবল রাজনৈতিক বিতর্ক নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধেও এক চরম সাংঘর্ষিক বাস্তবতা।
✍ রিপোর্টিং ডেস্ক | রাজনীতি